বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে লোকসান ঠেকানোর উদ্যোগ
স্টাফ রিপোর্টার
আপলোড সময় :
১৮-১২-২০২৪ ১২:৩০:০৫ অপরাহ্ন
আপডেট সময় :
১৮-১২-২০২৪ ০১:৩৬:০০ অপরাহ্ন
সংবাদচিত্র: সংগৃহীত
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সহায়তা দিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) যে ঋণ দিয়েছে, তার অন্যতম শর্ত ছিল তিন বছরের মধ্যে পর্যায়ক্রমে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমিয়ে লোকসান শূন্যে নিয়ে আসা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর ঋণের চতুর্থ কিস্তি ছাড়ের আগে আইএমএফের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হবে না বলে জানিয়ে দেওয়া হয়। লোকসান কমাতে সিস্টেম লস কমানো ও অভ্যন্তরীণ ব্যয় সংকোচনের কথা বলা হয়। এখন বিতরণ কোম্পানিগুলো সেদিকেই মনোযোগ দিচ্ছে।
বিতরণ কোম্পানিগুলোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে কম দামে বিক্রি করায় দুই মাস ধরে লোকসান হচ্ছে। সামনে লোকসান কমে এলেও এ থেকে মুক্তি মিলবে না, যতক্ষণ না বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। তারা জানান, লোকসান কমাতে প্রতিটি কোম্পানি নিজ নিজ অভ্যন্তরীণ ব্যয় কমাচ্ছে। পাশাপাশি বিদ্যুতের সিস্টেম লস কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
লোকসান হওয়া এবং দাম বাড়ানোর বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিদ্যুতের ট্যারিফ বাড়ানো হলে অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে জনমনে নেতিবাচক বার্তা যাবে। কারণ, দেশের মানুষ এখন দ্রব্যমূল্য নিয়ে চাপে আছে। তবে বিতরণ কোম্পানিগুলো বলছে, লোকসান আরও কমাতে হলে কোনো কোনো শ্রেণিকে চিহ্নিত করে দাম বাড়ানো যেতে পারে। এতে সাধারণ গ্রাহকদের ওপর চাপ তৈরি হবে না। তিনি বলেন, বিদ্যুতের উৎপাদন পর্যায়ে ভর্তুকি দিলেও গ্রাহক পর্যায়ে কোনো ভর্তুকি দেওয়া হয় না।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম এ প্রসঙ্গে বলেন, বেশি দামে কিনে কম দামে গ্রাহকদের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করায় লোকসান হচ্ছে। এই লোকসান কমাতে হলে ট্যারিফ বাড়াতে হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর হলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে গ্রাহকদের ওপর। তাই আমরা লোকসান কমাতে নিজেদের (অভ্যন্তরীণ) ব্যয় ও সিস্টেম লস কমানোর ওপর জোর দিচ্ছি। এতেও লোকসান থেকে যাবে। তবে ভবিষ্যতে সরকার মনে করলে বিশেষ ক্ষেত্রে কোনো কোনো শ্রেণির ট্যারিফ বাড়াতে পারে। এটা একেবারেই সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সিদ্ধান্ত। সরকারের তরফ থেকে আমাদের নির্দেশনা দিলে আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে দেশের চাহিদা বিবেচনা না করেই একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হয়েছে। এমনকি জ্বালানির সংস্থান না থাকার পরও বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হয়েছে। এই ধরনের হঠকারী পরিকল্পনার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে। উচ্চ জ্বালানি ব্যয়ের কারণে এবং মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বাড়ার কারণে গত দুই বছরে খরচ অনেক বেড়েছে।
বিতরণকারী কোম্পানিগুলোর সর্বশেষ আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সব বিতরণ কোম্পানিই লোকসান করেছে। তবে এর আগের ২০২১-২২ অর্থবছরে পাঁচটি বিতরণ কোম্পানির মধ্যে তিনটি লাভে ছিল। যদিও একই সময়ে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম চার দফা বাড়ানো হয়েছিল। দাম বাড়ানোতে গত অর্থবছরে চারটি কোম্পানির লোকসান কমে এসেছে। কেবল পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলোর লোকসান বেড়েছে।
পিডিবি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ পড়ছে ১১ টাকার বেশি। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরের শুরুতে এর বিক্রয়মূল্য ছিল পাইকারিতে ৫ টাকা ১৭ পয়সা। পরে তা তিন দফা দাম বৃদ্ধি করা হয়। এতে গত ফেব্রুয়ারিতে বিদ্যুতের পাইকারি মূল্যহার দাঁড়ায় ৭ টাকা ৪ পয়সা। অর্থাৎ পাইকারিতে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ৩৬ দশমিক ১৭ শতাংশ। এ সময় বিতরণ পর্যায়ে দাম বাড়ানো হয় ২৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ। পাইকারির চেয়ে খুচরায় বিদ্যুতের দাম কম বাড়ায় বিতরণ কোম্পানিগুলো লোকসানে পড়ে। গত ফেব্রুয়ারিতে বিতরণ পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি ডিমান্ড চার্জ বাড়ানো হয়েছে। এতে গত অর্থবছর লোকসানের পরিমাণ ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় কমেছে। তবে ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম কমপক্ষে আরও ১০ শতাংশ বাড়ানো কথা বলছেন বিতরণ কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তারা।
ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) ও ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো)। এ দুই কোম্পানির মধ্যে ২০২১-২২ অর্থবছরে ডিপিডিসি মুনাফা করে ১৬৬ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। এর পরের ২০২২-২৩ অর্থবছরে কোম্পানিটি ৬৪৩ কোটি ২৭ লাখ টাকা লোকসান করে। তবে অভ্যন্তরীণ ব্যয় সংকোচন ও সিস্টেম লস কমিয়ে আনার কারণে ২০২৩-২৪ অর্থবছর কোম্পানির লোকসান অর্ধেকে নেমে এসেছে। গত অর্থবছর ডিপিডিসি লোকসান করেছে ৩০২ কোটি ৯৫ লাখ টাকা।
ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আব্দুলাহ নোমান বলেন, আমরা অপারেশনাল কস্ট ও সিস্টেম লস কমানোর মাধ্যমে লোকসান অর্ধেক কমিয়েছি। আরও কমানোর চেষ্টা করছি। এখন ইউনিটপ্রতি ১৫ পয়সা করে লোকসান হচ্ছে। ট্যারিফ অ্যাডজাস্ট না হলে লোকসান মিনিমাম পর্যায়ে আনা সম্ভব হবে না।
ঢাকার বিদ্যুৎ বিতরণের অন্য কোম্পানি ডেসকো ২০২১-২২ অর্থবছর লাভ করেছিল ৬৬ কোটি ৭১ লাখ টাকা। আর ২০২২-২৩ অর্থবছর ৫৫৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকা লোকসান করে। পরের ২০২৩-২৪ অর্থবছর লোকসান করে ৫১৮ কোটি ৪ লাখ টাকা।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে থাকা ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ওজোপাডিকো) ২০২১-২২ অর্থবছর লোকসান ছিল ৮ কোটি ১৯ লাখ টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছর লোকসান বেড়ে ২৭৩ কোটি ৩ লাখ টাকা হয়। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছর লোকসান কিছুটা কমে, যার পরিমাণ ২০৯ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।
দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে থাকা নর্দান ইলেকট্রিসিটি কোম্পানি (নেসকো) ২০২১-২২ অর্থবছর মুনাফা করে ৩১ কোটি ১২ লাখ টাকা। পরের ২০২২-২৩ অর্থবছর লোকসান করে ৮৭ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছর লোকসান কমে দাঁড়ায় ২৪ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। চার বিতরণ কোম্পানির বাইরে চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা অঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্ব পালন করে পিডিবি নিজেই। এ কোম্পানিটি আগে থেকেই লোকসানে আছে।
এ ছাড়া দেশের সবচেয়ে বেশি গ্রাহক হচ্ছে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি)। মোট ৮০ সমিতির মাধ্যমে কোম্পানিটি বিদ্যুৎ সরবরাহ করে থাকে। ২০২১-২২ অর্থবছর সমিতিগুলোর একত্রিত লোকসান ছিল ৫২৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছর তাদের লোকসান বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৪৯২ কোটি ৪১ লাখ টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছর তা আরও বেড়ে হয় ২ হাজার ৭২৮ কোটি ১৩ লাখ টাকা।
বাংলাস্কুপ/ডেস্ক/এনআইএন
প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স